23 June, 2024

রাসেলস ভাইপার (চন্দ্রবোড়া সাপ): পরিচিতি ও সতর্কতা

রাসেলস ভাইপারের পরিচিতি

রাসেলস ভাইপার, বাংলায় যাকে চন্দ্রবোড়া সাপ বলা হয়, একটি অত্যন্ত বিষাক্ত সাপ। এটি ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল এবং পাকিস্তানে পাওয়া যায়। ইংরেজ প্রকৃতিবিদ জর্জ শ এবং চিত্রশিল্পী ফ্রেডেরিক পলিডোর নডার ১৭৯৭ সালে প্রথম এর বর্ণনা করেন। ভারতবর্ষে চারটি প্রধান বিষাক্ত সাপের একটি হিসেবে এটি পরিচিত।

এই সাপটি সাধারণত উন্মুক্ত ঘাসযুক্ত বা ঝোপঝাড় এলাকায়, বনাঞ্চল এবং চাষাবাদ উপযুক্ত এলাকায় পাওয়া যায়। এটির দেহের উপরের অংশ হলুদ, খয়েরি বা বাদামী রঙের সঙ্গে কালো রঙের দাগযুক্ত। এর এমন বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ সহজে একে দেখতে পায়না। এটি প্রধানত সমতল এলাকা, উপকূলীয় নিম্নভূমি, নদীর তীরবর্তী এলাকা এবং পাহাড়ের উপযুক্ত আবাসস্থলে পাওয়া যায়।

Russell's Viper
রাসেলস ভাইপার (চন্দ্রবোড়া সাপ): পরিচিতি ও সতর্কতা

স্বভাব ও আক্রমণাত্মকতা

চন্দ্রবোড়া সাপ সাধারণত মানুষকে এড়িয়ে চলে, তবে একটি সীমার পর বিরক্ত করলে প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। প্রতিবছর সাপের কামড়ে যত মানুষ মারা যায়, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মারা যায়। তবে "মানুষকে তেড়ে এসে কামড়ায়" এ কথা গুজব মাত্র। এরা মূলত Ambush predator, তাই এক জায়গায় চুপ করে পড়ে থাকে। মানুষ বা বড় কোন প্রাণী সামনে এলে ইংরেজি অক্ষর S আকৃতির কুণ্ডলী পাকিয়ে খুব জোরে জোরে "হিস্ হিস্" শব্দ করে। তারপরও তাকে বিরক্ত করা হলে তবেই অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছোবল মারতে পারে। ছোবল দেওয়ার সময় শরীরের সামনের দিকটা ছুঁড়ে দেয় বলে ঐ "তেড়ে এসে কামড়ায়" জাতীয় ভুল ধারণার জন্ম।

এদের বিষদাঁতের আকার অন্যান্য ভাইপার জাতীয় সাপের সাথে তুলনীয় এবং কিছু র‍্যাটেলস্নেকের প্রজাতির থেকে ছোট। এরা প্রচণ্ড জোরে হিস হিস শব্দ করতে পারে। চন্দ্রবোড়া দিনে ও রাতে উভয় সময়ে কামড়ায়। অন্য সাপ মানুষকে দংশনের পর সেখান থেকে দ্রুত সরে যায়, কিন্তু চন্দ্রবোড়া অনেক সময় দংশন করে কামড় ধরে রাখে।

অন্যান্য সাপের মতোই চন্দ্রবোড়াও সাধারণত মানুষকে এড়িয়েই চলে, কিন্তু লোকালয়ের কাছাকাছি ক্ষেতে কিংবা ঘাসজমিতে, কিংবা অনেক সময় ইঁদুর শিকার করতে লোকালয়ে ঢুকে পড়ার ফলে মানুষের সঙ্গে এর সংঘাত প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ কেবল এ সাপটির কামড়েই প্রাণ হারান। আক্রমণের ক্ষিপ্র গতি ও বিষের তীব্রতার কারণে ‘কিলিংমেশিন’ হিসেবে বদনাম রয়েছে সাপটির। তবে এই সাপ সম্পর্কে নানা অতিরঞ্জিত গুজবও ছড়িয়ে পড়ছে বর্তমানে।


প্রজনন

সাপ সাধারণত ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। তবে চন্দ্রবোড়া সাপ ডিম পাড়ার পরিবর্তে সরাসরি বাচ্চা দেয়। ফলে সাপের বাচ্চাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এরা বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করে। তবে মে থেকে পরের তিন মাস প্রজনন সবচেয়ে বেশি ঘটে। একটি স্ত্রী সাপ গর্ভধারণ শেষে ২০ থেকে ৪০টি বাচ্চা দেয়। তবে কোনো কোনো চন্দ্রবোড়া সাপের ৮০টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়ার রেকর্ড আছে।


বিষ ও তার প্রভাব

চন্দ্রবোড়ার বিষদাঁত solenoglyphous, অর্থাৎ মুখ বন্ধ করলে দাঁত ভাঁজ হয়ে মুখের সঙ্গে সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। একটি চন্দ্রবোড়া সাপ এক ছোবলে বেশ খানিকটা বিষ ঢালতে পারে। পূর্ণবয়স্ক সাপের ক্ষেত্রে বিষের পরিমাণ ১৩০-২৫০ মিলিগ্রাম হয়ে থাকে। ৭৯ সেমি (৩১ ইঞ্চি) গড় দৈর্ঘ্যের শিশু চন্দ্রবোড়ার বিষের পরিমাণ ৮ থেকে ৭৯ মিলিগ্রাম (গড় ৪৫ মিলিগ্রাম) অবধি দেখা গেছে।


বিষক্রিয়া ও লক্ষণ

রাসেলস ভাইপার কামড়ালে তৎক্ষণাৎ কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যার ফলে দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন:

- ব্যথা এবং ফোলা: কামড়ের জায়গায় তৎক্ষণাৎ ব্যথা এবং ফোলা শুরু হয়।

- রক্তপাত: মাড়ি, প্রস্রাব এবং থুথুতে রক্তপাত দেখা দিতে পারে।

- রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন হ্রাস: রক্তচাপ কমে যায় এবং হৃদস্পন্দন হ্রাস পায়।

- ব্লিস্টারিং এবং নেক্রোসিস: কামড়ের জায়গায় ফোসকা পড়ে এবং ত্বকের কিছু অংশের মৃত্যু হতে পারে।

- বমি এবং মুখের ফোলা: প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে বমি এবং মুখের ফোলা দেখা যায়।

- কিডনি ফেলিওর: চিকিৎসা না করলে প্রায় ২৫-৩০% ক্ষেত্রে কিডনি ফেলিওর হতে পারে।

- ডিসেমিনেটেড ইন্ট্রাভাসকুলার কোঅ্যাগুলেশন: গুরুতর বিষক্রিয়ায় রক্ত জমাট বাঁধা শুরু হতে পারে, যা হতে পারে মৃত্যুর কারণ।

রাসেলস ভাইপার কামড়ানোর পরে ২৯% ক্ষেত্রে পিটুইটারি গ্রন্থির গুরুতর ক্ষতি হতে পারে, যা হাইপোপিটুইটারিজম নামক অসুখের কারণ হতে পারে।


অ্যান্টিভেনম চিকিৎসা

রাসেলস ভাইপার কামড়ানোর পরে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করা উচিত। দ্রুত চিকিৎসা ও এন্টিভেনম ব্যবহারের মাধ্যমে গুরুতর ও প্রাণঘাতী জটিলতা এড়ানো যায়। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে বিষধর সাপের বিষ প্রতিরোধের জন্য যে Polyvalent antivenom প্রয়োগ করা হয়, তার দ্বারাই চন্দ্রবোড়ার বিষেরও প্রতিরোধ সম্ভব। ২০১৬ সালে কোস্টারিকার Clodomiro Picado Institute একটি নতুন অ্যান্টিভেনম তৈরি করেছে এবং শ্রীলঙ্কায় তা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।


চিকিৎসাক্ষেত্রে এর বিষের প্রয়োগ

চন্দ্রবোড়ার বিষ রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে, একারণে হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে রক্ত জমাট বাঁধা সংক্রান্ত পরীক্ষায় এর ব্যবহার হয়। রক্ত জমাট বাঁধা, গর্ভধারণ বিষয়ক জটিলতা যেমন- গর্ভপাতকারী এক রোগ নির্ধারণের পরীক্ষায় (ডাইলিউট রাসেল'স ভাইপার ভেনম টাইম) লুপাস অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্টের উপস্থিতি নির্ণয়ে চন্দ্রবোড়ার বিষ ব্যবহৃত হয়।


সাপটির বর্তমান অবস্থা

২০০৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষে এটিকে বাংলাদেশে মহাবিপন্ন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে এ প্রজাতিটিকে সংরক্ষিত বলা হয়। তবে বর্তমানে উপযুক্ত পরিবেশ পাবার কারণে এই সাপটির সংখ্যা দ্রুত গতিতে বেড়ে চলছে।


সচেতনতা ও সতর্কতা

চন্দ্রবোড়া সাপের বিষাক্ত হওয়ার কারণে, এর কামড়ানোর ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:

- কর্মক্ষেত্রে সতর্কতা: গ্রামাঞ্চল ও চাষের জমিতে কাজ করার সময় সতর্ক থাকতে হবে।

- আবাসস্থলে সতর্কতা: এই সাপগুলি প্রায়ই মানুষের কাছাকাছি আসে ইঁদুর খাওয়ার জন্য, তাই বাড়ির আশেপাশে সতর্ক থাকা উচিত।

- প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান: প্রাথমিক চিকিৎসার কিছু সাধারণ নিয়ম জানা থাকলে জীবন রক্ষা করা সম্ভব।


সবার উচিত রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। যা আমাদের জীবন রক্ষা করতে সাহায্য করবে এবং এই সাপের বিষক্রিয়া থেকে সুরক্ষা প্রদান করবে।


তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনায়

ফার্মাসিস্ট মিঠুন সমদ্দার


#russellsviper #snake #awareness 

No comments:

Post a Comment